হাফেজি মাদরাসায় কেন বই পড়তে দেওয়া হয় না? - আব্দুল্লাহ আল মাসুদ
লিখেছেন লিখেছেন আওণ রাহ'বার ২৩ এপ্রিল, ২০১৬, ০৮:১৩:৩২ রাত
হাফেজি মাদরাসা বা হিফজখানায় দীর্ঘ একটা সময় আমি কাটিয়েছি। আল্লাহর দয়ায় পুরো কুরআন মুখস্ত করারও সুযোগ হয়েছে। সে হিসেবে শিরোনামের উপর কিছু কথা বলবো। এগুলো কোন ফাঁকাবুলি নয়। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বাস্তব পর্যবেক্ষণ এবং মূল্যায়ন।
হিফজখানায় একটা ছেলে ভর্তি হয় পুরো কুরআন শরীফ মুখস্ত করার স্বপ্ন নিয়ে। "পুরো কুরআন মুখস্ত করা" কথাটার উপর বার কয়েক নজর বুলান। প্রায় ৬০০ পৃষ্ঠার একটা গ্রন্থ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন ধরণের দ্বিরুক্তি ছাড়াই এক বসায় শুনিয়ে দিতে পারাটা কি আপনার কাছে রূপকথার গল্প বলে মনে হয় না? এই রূপকথাকেই বাস্তব করে তোলে একজন হাফেজি মাদরাসার ছাত্র। একে আপনি অসাধ্য সাধন বা ভিন্ন কোন নামও দিতে পারেন। বিশ্বাস না হলে সবচে সহজ সূরা ইয়াসিনটা আজ থেকে মুখস্ত করা শুরু করুন। কথাগুলোর হাকিকত বুঝতে সময় লাগবে না।
এই অসাধ্য সাধন করার জন্য একটা ছেলেকে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ ঢেলে দিতে হয় কুরআনের পাতায়। নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর দিয়ে তাকে কাটাতে হয় প্রতিদিনের প্রতিটি ক্ষণ। রুটিনবাঁধা ছন্দে চলতে থাকে তার জীবন। ফজরের আজানের আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টা আগে তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেওয়া হয়। কনকনে শীতের রাতে যখন পুরো পৃথিবী আরামের ঘুমে বিভোর তখন সে ঠাণ্ডা পানিতে ওজু করে জুবুথুবু হয়ে পড়তে বসে যায়। কুরআনের মিষ্টিসুরে মুখরিত হয় হাফেজি মাদরাসার শেষরাতের নিঝুম-নিরব অন্ধকার।
দিনে দুই ঘণ্টা ঘুম আর রাতে কিছু ঘুমের সময় বাদে বাদবাকি পুরোটা সময় তাকে পড়ে থাকতে হয় কুরআন নিয়ে। দিনের পর দিন যুদ্ধ চলে তার। এক পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা করে সে জয় করতে থাকে কুরআনের পাতাগুলো। কতোটা শ্রমসাধ্য এটা তা সরাসরি হিফজখানায় না পড়লে আপনি বুঝবেন না। এতো কঠিন-কঠোর পরিশ্রমের পরেও দেখা যায় অনেক ছেলে মুখস্ত পড়াগুলো স্মরণ রাখতে পারে না। বিস্মৃত হয়ে যায়। আবার নতুন করে শুরু হয় তার হারানো পড়াগুলো উদ্ধার করার কষ্টকর অভিযান। এটা আরো বেশি শ্রমসাধ্য ও দুঃসহ।
এই ছেলেটা যখন কুরআন বাদ দিয়ে বাংলা বই পড়ার নেশায় পড়ে যায় তখন তার হিফজমিশন যে হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়তে থাকে সেটা নতুন করে না বললেও আপনারা বুঝে ফেলছেন আশা করি। কারণ বইয়ের নেশায় পড়ে সে কুরআন মুখস্তের জন্য যে পরিমাণ মনোনিবেশ বিনিয়োগ করার দরকার তা পারে না। তাই দেখা যায় এমন ছেলেদের শেষ পর্যন্ত হিফজ পড়াই হয় না। অথবা পড়া হলেও সেটা হয় দুর্বল। একটা মধ্যমমানের সুরা পড়তে গেলে দশটা জায়গায় আটকে যায়। তের নম্বর পারা পড়া শুরু করলে প্যাঁচ লেগে চলে যায় তেইশ নম্বর পারায়। এর বাস্তব উদাহরণ আমি।
আমার স্মৃতিশক্তি মোটেই খারাপ নয়। কিন্তু বইয়ের নেশায় পড়ে আমি আমার হিফজ বা কুরআন মুখস্তকে অতোটা পোক্ত করতে পারি নি যতোটা করা দরকার ছিল। আমার বইপড়ার নেশায় আসক্ত হওয়া, তারপর উস্তাদদের চোখ ফাকি দিয়ে বই পড়ার গল্পগুলো আরেকদিনের জন্য তোলা রইলো। আজকে আমরা আলোচ্চ বিষয়টাতেই থাকি।
প্রত্যেকটা কাজ যথাসময়ে করাটাই মানাসই। গ্রীষ্মের তাপদাহে গরম পানি গেলা বা প্রচণ্ড শীতের রাতে ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ঠা পানীয় গলায় ঢালা বোকামি। বই পড়ার মতো যথেষ্ট সুযোগ আমি পরবর্তী জীবনে পেয়েছি। হিফজখানায় থাকাকালীন বইপাঠের পিছনে সময় খরচ করে নিজের হিফজকে দুর্বল না করলেও কোন ক্ষতি তো হতই না বরঞ্চ লাভই হতো। কারণ তখন আমার হিফজটাও পাকাপোক্ত থাকতো আর বই পড়ার মত প্রচুর সময় তো পরবর্তীতে পেয়েছিই। একূল ওকূল দু'কূলই থাকতো। এখন তো আমাকে এককূর নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে।
মূলত যারা হাফেজি মাদরাসায় পড়াকালীন বইপড়ার নেশায় আসক্ত হয়। ঘুম বাদ দিয়ে, ক্লাস ফাকি দিয়ে বই পড়ে তাদের হয়ত শেষ পর্যন্ত পুরো কুরআন মুখস্ত করা হয়ে উঠে না। ছিটকে পড়তে হয় এই আলোকিত পথ থেকে অথবা কোন মতে যদি টিকে থাকতেও পারে তবে তার হিফজ অতোটা পাকাপোক্ত হয় না। ফলে এ দুর্বলতার কষ্ট আজীবন তাকে তাড়া করে ফিরে। এই বাস্তবতার আলোকেই শিক্ষকরা কোন ছেলেকে হিফজপড়াকালীন অন্য বইপত্র পড়ার নেশায় আসক্ত হতে দেয় না। কে চায় তার বাগানের একটা কলি, আজ বাদে কাল যে প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে সুরভি বিলাবে, অযথাই ঝরে পড়ুক? আপনি চাইবেন? আমি চাইবো?? কেউ-ই না।
বিষয়: বিবিধ
২৭১৮ বার পঠিত, ৩২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আপনার উপলব্ধি চমৎকার মাশাআল্লাহ।
আসলে ছোটবেলায় কুরআন একধ্যানে পড়তে হয়; আর জীবনভর কুরআনচর্চা করতে হয়। গাফলতে থাকলে যে কোন সময় কুরআন ক্বলব থেকে চলে যেতে পারে- এটা নিজের চোখে দেখেছি। বিধি-নিষেধগুলো অতীব প্রয়োজন। শুকরিয়া অনেক অনেক।
ধন্যবাদ গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের জন্য।
অনেকদিন পর ব্লগে ঢুকতে পারলাম। এর জন্য জবাব দিতে দেরি হলো।
শুনেছিলাম চলন্ত লাইব্রেরী নামে খ্যাত আল্লামাহ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহঃ হাজারো কিতাবের হাফেজ ছিলেন, কিন্তু কুরআনের হাফেজ হতে পারেননি। তাই বলছি এটি আল্লাহ তায়ালার বিশেষ ফজল ও করম।
এত অনুগ্রহ পাওয়ার পরও যারা হিফজ শেষ করার পর বিপথে পা বাড়ায় ও কুরআনকে দুনিয়ার বিনিময়ে বিক্রি করে, তাদের জন্য বড়ই আফসোস হয়।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহ খাইর
আপনার মন্তব্যটির উদাহরণ খুব ভালো লাগলো। টুকে নিলাম হৃদয়ে।
ধন্যবাদ ভাইয়া ।
আমি কিন্তু আপবার সাথে ১০০% সহমত পোষণ করলাম।
জাযাকাল্লাহ
অনেক ভাল লাগল
অনেক দিন পর দেখছি আপনাকে। ভালো থাকবেন এই কামনায়।
"কে চায় তার বাগানের একটা কলি, আজ বাদে কাল যে প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে সুরভি বিলাবে, অযথাই ঝরে পড়ুক? আপনি চাইবেন? আমি চাইবো?? কেউ-ই না।"
মহান আল্লাহ আমাদর সবাইকে হেদায়েত দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে নেক কামিয়াবী দান করুন, আমীন।
- আমীন ইয়া রব্ব।
জাযাকাল্লাহু খাইরান।
বারাকাল্লাহু ফীক।
যথার্থ বলেছেন, সহমত
হিফজ একটি অতি সংবেদনশীল বিশেষ বিষয়- যেমন ডাক্তারী বা এরোনটিকস.. মনযোগের শতভাগ দেয়ার পরেও কমতি রয়ে যায়!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য আপনাকেও জাযাকাল্লাহ।
এ মহান রবের এক নিয়ামত। রবের রহমত ছাড়া তা অর্জন সম্ভব নয়।
শুকরিয়া আপু।
দুঃখিত ভাই। আমার একটা লেখা লিখতে প্রচুর সময় দরকার হয়। আমার প্রায় চার বছরের ব্লগিং লাইফে মৌলিক লেখা ১০-২০ টা হবে হয়তো। আমি আসলে চাইলেই লিখতে পারিনা। উৎসাহের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন